in ,

সিঙ্গাপুর ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ ‘সম্পর্কের’ নেপথ্যে

আন্তর্জাতিক কূটনীতি এক জটিল গোলকধাঁধা, যেখানে কে কার মিত্র এবং কে কার শত্রু তা সূত্র মিলিয়ে বলা দুষ্কর। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনে বোমাবর্ষণ শুরু করে হামাসের হামলার ‘প্রতিশোধ’ নিতে, তখন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে হয় এই যুদ্ধের জেরে মালয়েশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে না। 

মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মত দুইটি মুসলিম প্রধান ও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দেয়া দেশের মাঝখানে অবস্থান করা সিঙ্গাপুর কেন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি এবং তাদের ‘প্রতিরক্ষার’ অধিকারকে সমর্থন দেয়, এবং কীভাবে সিঙ্গাপুর ইসরায়েলিদের বৈশ্বিক গোয়েন্দা সরঞ্জামের বাজার সম্প্রসারণে জড়িত, তা বুঝতে যেতে হবে একটু পেছনে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠকদের জন্য এই আলাপটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

যেভাবে সিঙ্গাপুরের জন্ম

উনবিংশ শতকে সিঙ্গাপুর ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র (Trading Post)। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান দখল করে দেয় ভূখণ্ডটি। তবে বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের সাথে সাথে সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রণ হারায় জাপান, ভূখণ্ডটি পরিণত হয় ব্রিটিশ উপনিবেশে। ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়া স্বাধীন হলে সিঙ্গাপুর হয় মালয়েশিয়ার ফেডারেশনের অংশ। স্বাধীন মালয়েশিয়া শুরুতেই সংঘাতে জড়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্দোনেশিয়ার সাথে। এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সিঙ্গাপুরেও যখন সেখানকার চীনা অভিবাসীদের সাথে মালয়দের তিক্ততা শুরু হয়।  

পরে ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট, দুই বছরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তিক্ততার পর, মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে সিঙ্গাপুর।

সিঙ্গাপুরকে ঘিরে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সংঘাত, ভূরাজনীতি এবং নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন নিয়ে সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক নেতাদের দুশ্চিন্তা ছিল। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং কোন মূল্যবান খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য না থাকা একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুরকে একদিকে যেমন চিন্তা করতে হচ্ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে, অন্যদিকে তাদের মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ তাদেরকে ভাবিয়ে তুলছিল নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও। এছাড়া ব্রিটিশ সেনাদের যে দল সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তায় কাজ করছিল, তারাও যে সিঙ্গাপুরকে আজীবন নিরাপত্তা দিয়ে যাবে তা ভাবারও কোন কারণ ছিল না। 

সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ দেশটিকে তুলনা করেছিলেন বিষাক্ত চিংড়ির সাথে, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গ্রাস করে আর ছোট মাছ যেমন চিংড়ি শিকার করে সিংগাপুরের অবস্থাও তখন তেমনই ছিল।

এই পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরকে দ্বারস্থ হতে হয় এমন এক দেশের, যেই দেশকে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া স্বীকৃতিই দেয় না।

সিঙ্গাপুর-ইসরায়েল সামরিক সহযোগিতা

স্বাধীন সিঙ্গাপুরের সশস্ত্র বাহিনী বলতে ছিল মূলত দুই ব্যাটেলিয়ন অদক্ষ সৈন্য, একটি পুরনো কাঠের গানবোট এবং হালকা কিছু অস্ত্র। দেশটির কোন যুদ্ধবিমানও ছিল না তখন। প্রায় শূন্য থেকে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে সিঙ্গাপুর প্রথমে ভারত ও মিশরের সাহায্য চায়। কিন্তু কাঙ্খিত সাড়া না পাওয়ায় লি কুয়ান তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোহ কেং সেওকে অন্য মিত্র দেশের সন্ধানে নামতে বলেন। 

জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড. গোহ তখন যোগাযোগ করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোরদেসাই কিদরনের সাথে, কারণ তিনি মনে করতেন ছয়টি ‘শত্রুভাবাপন্ন’ মুসলিমপ্রধান দেশের মাঝখানে ইহুদী-অধ্যুষিত ইসরায়েল যেভাবে ‘টিকে’ আছে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে, সেভাবে নিজেদের সেনাদের তৈরি করলে সিঙ্গাপুরও দুইটি বৈরি মুসলিম দেশের মাঝে টিকে যেতে পারবে। 

এই পুরো বিষয়টি উঠে এসেছে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত Beating The Odds Together: 50 Years of Singapore-Israel Ties বইতে।

সিঙ্গাপুরের এই যোগাযোগের পর ইসরায়েলেরর মেজর জেনারেল রেহেম জিভ দুইটি সামরিক দল নিয়ে সিঙ্গাপুরে এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যান এবং মোসাদের সাথে বৈঠক করে সিঙ্গাপুরের সশস্ত্র বাহিনী, সংক্ষেপে সাফের বিকাশের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ইতিহাসের পাতায় এই পরিকল্পনাকে The Brown Book হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। 

পরিকল্পনাটি সিঙ্গাপুর প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হওয়ায় উভয় দেশ একটি এক পৃষ্ঠায় লিখিত চুক্তিতে যায় যেখানে উল্লেখ ছিল যে ইসরায়েল সাফের জন্য যোগ্য সামরিক পরামর্শদাতা ও যথোপযুক্ত পরামর্শ প্রদান করবে এবং বিনিময়ে তারা ভাতা, খাদ্য ও বাসস্থান পাবে।

কিন্তু কূটনৈতিক কারণে বিষয়টি বহির্বিশ্বের কাছে গোপন রাখা হয়, এমনকি সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ইসরায়েলি পরামর্শদাতাদের মেক্সিকান হিসেবেও পরিচয় দেওয়া হয়। এছাড়া সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন করা হয় যেখানে ইসরায়েল থেকে প্রশিক্ষক ও প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ক্রমাগত এই কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় যার কারণে ইসরায়েল প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি – উভয় দিক দিয়েই সিঙ্গাপুরের সামরিক শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে। ফলাফল স্বরূপ প্রতিবেশি দেশগুলোর থেকেও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে যায় সিঙ্গাপুর।

সিঙ্গাপুরে ইসরায়েলিদের গোয়েন্দা সরঞ্জামের বাজার

গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম তৈরির প্রযুক্তিতে ইসরায়েল বরাবরই এগিয়ে। তাই ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম ও আড়িপাতার যন্ত্র কিনে থাকে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে মুসলিম প্রধান কয়েকটি দেশসহ বেশ কিছু দেশের ইসরায়েলের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। আবার ইসরায়েল সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত দেশগুলোতে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলো নজরদারি সরঞ্জাম বিক্রি করতে পারে না।

সিঙ্গাপুর-ইসরায়েলের ঐতিহাসিক সামরিক সহায়তা সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তাই বেশ কিছু ইসরায়েলভিত্তিক গোয়েন্দা নজরদারি ও আড়িপাতার যন্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছে তাদের কার্যালয় এবং সেখান থেকেই ইসরায়েল সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটাতে এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নেই এমন দেশগুলোর সাথে ব্যবসা করতেও তাদের সমস্যা হচ্ছে না। 

ইসরায়েলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোরালকো টেক, পিকসিক্স ও সেলব্রাইট তাদের সিঙ্গাপুর কার্যালয় থেকে গোয়েন্দা নজরদারি ও আড়িপাতার যন্ত্র সরবরাহ করে থাকে বলে উঠে এসেছে হারেৎজ ও আল-জাজিরার প্রতিবেদনে। কোরালকো টেক, পিকসিক্সসেলব্রাইটের কাছ থেকে বাংলাদেশও বিভিন্ন সময়ে সরঞ্জাম কিনেছে, যদিও দেশটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না এবং ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের লড়াইকে সমর্থন করে। 

What do you think?

Written by Rodaba Jaman

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মরণীয় মুহূর্ত

লোকি কুইজ