বছর তিনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম আমি এবং আমার এক সহপাঠী। হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করলাম একজন পরিপাটি পোশাকধারী নারী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। দূর থেকে বোঝা না গেলেও কাছে আসার পর আমরা বুঝতে পারলাম যে আগন্তুক একজন ট্রান্সজেন্ডার, আমরা যাদেরকে হিজড়া বলে জানি। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম তাকে দেখে আমার বেশ সাহসী বন্ধুটি ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেছে।
হিজড়াগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। মানুষ সবসময়েই নিজের চেয়ে ভিন্ন কাউকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, এবং হিজড়াদের যে ছেলে/মেয়ের মতো সাদাকালো গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যায় না সেই বিষয়টা আমাদের অনেকের কাছেই আনন্দের বিষয় নয়। একে তো হিজড়ারা অন্য দশজনের চেয়ে ভিন্ন, তার উপর সংখ্যালঘু হওয়ায় স্বভাবতই তারা স্বাধীন নাগরিকের অধিকাংশ অধিকার থেকে বঞ্চিত- এবং এর জন্য দায়ী আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা।
হিজড়া কারা?
হিজড়া বলতে আমরা সেই মানুষদের বুঝি যারা শারীরিকভাবে এক লিঙ্গের মানুষ হলেও নিজেদের অন্য লিঙ্গের মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করে। এই “অন্য লিঙ্গ” বলতে বিপরীত লিঙ্গ হতে পারে, অথবা এমনও হতে পারে যে মানুষটি নিজেকে কোন লিঙ্গের মানুষ হিসেবেই মনে করে না। যে অর্থেই ব্যবহৃত হোক না কেন, এই কথা সত্য যে হিজড়া সম্প্রদায় মানবসমাজে প্রচলিত লিঙ্গের ধারণায় আঘাত হানে। ফলাফল- হিজড়ারা বঞ্চিত হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে। হিজড়ারা বৈষম্যের স্বীকার হয় শিক্ষাঙ্গণে, সামাজিক জীবনে, পারিবারিক জীবনে, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও- শুধুমাত্র নিজেদের সমাজের ছাঁচে গড়তে অপারগ হওয়ার কারণে।
পারিবারিক অবস্থান
সমাজ তো বটেই, নিজের পরিবারও হিজড়াদের দূরে ঠেলে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজড়াদের স্থান হয় না নিজ পরিবারেও- এবং যেহেতু হিজড়াদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়, সেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজড়ারা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় হিজড়া পল্লীতে, যেখানে জীবিকার তাগিদে অনিচ্ছাকৃতভাবেই তারা জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজি, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্নরকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এ যেন এক নিরন্তর চক্র- সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয় বলে হিজড়ারা অপরাধে যুক্ত হয়, এবং অপরাধে যুক্ত বলে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
দিন বদলের আভাস
তবে আশার কথা হল ধীরে ধীরে হলেও অবস্থার পরিবর্তন আসছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে পাসকৃত এক নীতি অনুযায়ী “হিজড়া” বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। এর অর্থ হছে, যে কোন সরকারি/বেসরকারি নথিপত্রে নারী/পুরুষের জায়গায় হিজড়ারা নিজেদের আসল পরিচয় দিতে পারবে। ২০১৫ সালে থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে হিজড়াদের সরকারি চাকরীতে আবেদনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছে। এছাড়াও সরকারিভাবে হিজড়াদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে হিজড়া অধিকার সংরক্ষণের জন্য সংসদে একটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। এই আইন পাশ হলে সম্পত্তি থেকে হিজড়াদের বঞ্চিত করা, বাসস্থানের অধিকারে বাধাদান, শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গের কারণে বৈষম্যকরণ, এবং লিঙ্গের কারণে যৌন বা অন্য যে কোন ধরণের নিপীড়ন- ইত্যাদি সবকিছুই দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও হিজড়াদের অধিকারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও পিছিয়ে, তবুও আশানরূপ প্রগতি লক্ষণীয়।
সামাজিক সচেতনতা
হিজড়াদের অধিকার আদায়ে সরকারি উদ্যোগ কখনোই যথেষ্ট নয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, যত আইনই করা হোক না কেন, সামাজিকভাবে যদি আমরা হিজড়াদের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো মানুষ হিসেবে মেনে নিতে না পারি, তবে কোন আইন টেকসই উন্নতি বয়ে নিতে আসবে না। তাই সহিষ্ণুতা-শিক্ষার প্রতি আমাদের জোর দেওয়া উচিত ছোটবেলা থেকেই, যেন শুধুমাত্র ভিন্ন হওয়ার কারণে আর কাউকে নিপীড়নের স্বীকার হতে না হয়।
This article is made possible by the support of the American People through the United States Agency for International Development (USAID.) The contents of this article are the sole responsibility of the Quizards project and do not necessarily reflect the views of USAID or the United States Government.