in , ,

ইরান কেন ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছিল?

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সাথে ইসরায়েলের সাপে-নেউলে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কোন পক্ষেরই কোন রাখঢাক নেই। দুই দেশই একাধিকবার একে অপরের স্থাপনায় হামলার হুমকি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করেছে। ইসরায়েলের সাথে লড়াইরত প্রতিটা বাহিনীকেই ইরানের ‘প্রক্সি’ হিসেবে দেখা হয়।

কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে প্রচণ্ড তিক্ততা থাকলেও আশির দশকে এই ইসরায়েল থেকেই অসংখ্য অস্ত্র কিনেছিল ইরান। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখা।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ

১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে পতন হয় মোহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভীর। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হন তার অনুসারীরা, নিপীড়ক বাহিনী সাভাকের কর্মকর্তারা এবং সেনা কর্মকর্তারা। ইরান তাদের এই বিপ্লবকে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে ‘বিপ্লব রপ্তানি তত্ত্ব’ (Exporting the revolution) সামনে আনলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র এবং একনায়ক শাসকদের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়। এমনকি সৌদি আরবের পূর্বদিকের শিয়া অধ্যুষিত কাতিফ প্রদেশে মহররম আয়োজনকে কেন্দ্র করে সেই বছর একটি আন্দোলনের সময় ইরানের বেতার থেকে আন্দোলনকারীদের ‘অনুপ্রেরণা’ যোগানো হয়। 

১৯৮০ সালের শেষভাগে সাদ্দাম হোসেন, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য রাজতন্ত্রগুলোর মদদে যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত ইরানে আগ্রাসন অভিযান শুরু করলে ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে গঠন হওয়া নতুন সরকার বেশ চাপে পড়ে। এসময় বেশ কিছু বিষয়ে তারা নমনীয় হয়, যেমন রেজা পাহলভীর সরকারের নিয়োগ দেয়া বিমানবাহিনী কর্মকর্তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় যুদ্ধের অংশ নেয়ার জন্য। এছাড়া শাহের নিপীড়কবাহিনী সাভাকের কিছু কর্মকর্তাদেরকেও কাজে লাগানো হয়।

দ্রুতই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ইরানের পালটা হামলার মুখে ইরাকের আগ্রাসন অভিযান পরিণত হয় প্রতিরক্ষামূলক অভিযানে, কারণ ইরানের সেনাবাহিনী উলটো ইরাকে ঢুকে পড়ে।

ইসরায়েল থেকে অস্ত্র গেল ইরানে

আধুনিক সব যুদ্ধেই সমরনায়কদের দক্ষতা এবং সেনাবাহিনীর সাহসিকতার পাশাপাশি প্রয়োজন আধুনিক অস্ত্রের নিরবিচ্ছিন্ন যোগান। দীর্ঘসময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইরানের সেনাবাহিনী মূলত গড়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়, পশ্চিমাদের সরবরাহ করা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে। কিন্তু ইরানের বিপ্লবের পর রেজা পাহলভীকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেয়ার প্রতিবাদে ইরানের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মীদেরকে জিম্মি করার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তিক্ত হয়ে ওঠে ইরানের। একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় দেশটির উপর।

এই অবস্থায় ইরাকের সাথে যুদ্ধে জিততে ইরানকে নিরূপায় হয়ে দ্বারস্থ হতে হয় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের। ইসরায়েল তখন দুর্বল ইরানের চেয়ে ইরাকের পাগলাটে স্বৈরাচার সাদ্দামকে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল এবং তারা চাচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্য ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে যেন ব্যস্ত থাকে। তাই ইসরায়েলও রাজি হয়ে যায় ইরানকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে।

১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে ইসরায়েলের মেজর জেনারেল আভ্রাহাম তামিরের বক্তব্য ছাপা হয়। তিনি বলেন, “প্রতি মাসে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশের একটা তালিকা দিতাম যেগুলো আমরা ইরানের কাছে বিক্রি করতে চাই।”

তিনি আরও জানান যে প্রায় দেড় বছর এইভাবে একটি টাইপ করা তালিকা ইসরায়েলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে পৌঁছে দেয়া হত। “১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র সেক্রেটারি হাইগের সাথে একটি সমঝোতার মাধ্যমে ইরানের কাছে বিক্রি করা হত,” যোগ করেন জেনারেল তামির। এই সেক্রেটারি হাইগ হচ্ছেন রোনাল্ড রিগ্যানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সান্ডার হাইগ।

পরে ইসরায়েলে মাধ্যম এই অস্ত্র বিক্রি প্রক্রিয়া বন্ধ হলেও, ইসরায়েলি, মার্কিন কিংবা ব্রিটিশ অস্ত্র বিক্রেতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এসব অস্ত্র ইরানে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পৌঁছে গেছে, যার মূল্যমান ছিল তৎকালীন বাজারমূল্যেই কয়েক বিলিয়ন ডলার।

 

১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর দি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় খবরটি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ?

কিন্তু যেই যুক্তরাষ্ট্র রেজা পাহলভীকে আশ্রয় দিল এবং জিম্মি সংকট নিয়ে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা দিল, তারা কেন ইসরায়েলের মাধ্যমে ইরানে অস্ত্র পৌঁছে দিল এবং এখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি। প্রথমত ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় ইরান এবং ইরানের সমর্থনপুষ্টদের হাতে বন্দি বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক এই সময় মুক্তি পেয়েছিল এই অস্ত্র সরবরাহের জেরে। 

অন্যদিকে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন নির্বাচিত রোনাল্ড রিগ্যানের ভারসাম্য এবং নীতির লড়াই। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও রিগ্যানের সময় রিপাবলিকান পার্টি সিনেট এবং কংগ্রেস – সংসদের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় কার্টারের দল ডেমোক্র্যাটদের কাছে। একদিকে যেখানে ডেমোক্র্যাটরা রিগ্যানের অন্যদেশে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়, অন্যদিকে রিগ্যানের নির্বাচনী অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রতিহত করা এবং কমিউনিস্ট সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে সহায়তা করা। এই অবস্থায় বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা যেন অব্যহত থাকে সে ব্যাপারে কিছুটা কৌশলী হতে হয় রিগ্যান প্রশাসনকে। 

আশির দশকে নিকারাগুয়ার মার্ক্সিস্ট সাদিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ডানপন্থী কন্ট্রা বা প্রতিবিপ্লবী আন্দোলনকে সহায়তার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তা যোগান দেয়ার জন্য ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে সম্মতি দেয় রিগ্যান প্রশাসন। ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটি অংশ পৌঁছে দেয়া হতে থাকে নিকারাগুয়ার কন্ট্রাদেরকে।

রিগ্যান ক্ষমতায় থাকলেই বিষয়টি সামনে আসে। তার দুই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর ক্ষমতায় আসেন তার সরকারেরই উপ-রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ। তিনি এই ঘটনায় জড়িতদের ক্ষমা করে দেন। এরপর আর বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি।

এদিকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। দুই দেশই আন্তর্জাতিক সীমারেখা মেনে নিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি টানে।

সূত্র- দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, পিবিএস এবং হিস্ট্রি চ্যানেল

What do you think?

Written by Aaqib Md Shatil

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিউন কুইজ

মুক্তিযুদ্ধের যত যুদ্ধ কুইজ