in ,

যীশুর জন্ম ও ফিলিস্তিনে রোমান সাম্রাজ্য

প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় ক্রিস্টমাস বা বড় দিন। ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা কিছুটা তর্ক-বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও দুই হাজার বছর আগে ফিলিস্তিন অঞ্চলে যীশু খ্রিস্ট জন্মেছিলেন এই বিষয়ে একমত হয়েছেন। 

একটা মজার বিষয় হচ্ছে, যীশু খ্রিস্টের জন্মস্থান ও জন্মসাল নির্ধারণের সাথে জড়িয়ে আছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের তৎকালীন শাসক রোমান সাম্রাজ্যের কর ব্যবস্থা ও জনশুমারির গল্প। সেই বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে।

মার্বেলের নগরী

কথিত আছে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট আগস্টাস বলেছিলেন, “আমি রোমকে পেয়েছিলাম ইটের শহর হিসেবে এবং পরিণত করেছিলাম মার্বেলের শহরে।” মূলত তার সময়ে রোমে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনায় মার্বেল পাথরের ব্যাপক ব্যবহারকে ইঙ্গিত করে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন কীভাবে তিনি রোম নগরীকে বদলে দিয়েছিলেন। কিন্তু রোমের এই বদলে যাওয়ার পেছনে আছে কিছু রূঢ় বাস্তবতা।

আগস্টাস সিজারের সময় রোমান সাম্রাজ্যের পরিধি অনেক বৃদ্ধি পায়। তার সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মিশরে মার্ক অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রাকে পরাজিত করে রোমান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দি সিল্ক রোডসের লেখক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ পিটার ফ্র্যাঙ্কোপ্যানের মতে, নীল নদের পলিমাটিতে সমৃদ্ধ মিশর পুরোপুরি রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসায় সেখানে উৎপাদিত শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী রোমে অনেক কম মূল্যে বিক্রি হতে থাকে। ফলে রোমের অধিবাসীদের ডিসপোজেবল ইনকাম (disposable income) তথা প্রয়োজনীয় সব ব্যয় নির্বাহের পরেও যে অর্থ বাকি থাকতো তার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। ফলে রোমে নতুন বাড়ি তৈরি, ভাষ্কর্য তৈরি, বিলাস দ্রব্যের বিক্রি বেড়ে যায়। 

এছাড়া, এই নতুন দখল করা অঞ্চলে রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী অঞ্চল বাদে অন্যান্য অঞ্চলের মতই মাথাপিছু কর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই করের অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে রোম। 

আগস্টাস সিজারের সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার। কৃতজ্ঞতা- ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপেডিয়া

মাথাপিছু কর

মিশর দখলের কাছাকাছি সময়ে বর্তমান ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জুডেয়া অঞ্চলকেও যুক্ত করা হয় রোমান সাম্রাজ্যে। মিশরের মত এই অঞ্চলেও বসানো হয় মাথাপিছু কর, যা ষোল থেকে ষাট বছর বয়সী সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল, কিছু ব্যতিক্রম বাদে।

এই কর যেন সঠিকভাবে আদায় হয় তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ছিল সেই অঞ্চলের প্রতিটি নাগরিকের নাম ও বিস্তারিত তথ্য। তাই রোমান সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রতিনিধিরা তাদের অঞ্চলে জনশুমারি পরিচালনা করে। এছাড়াও নতুন জন্ম নেয়া শিশুদের নাম নিবন্ধন এবং মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নাম নিবন্ধন শুরু করে। পিটার ফ্র্যাঙ্কোপ্যানের মতে, বর্তমান ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জুডেয়া অঞ্চলে জন্ম নেয়া এক শিশুর নাম এভাবেই লিপিবদ্ধ হয়ে যায় কর সংগ্রাহকদের খাতায় — যীশু, যিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছে ঈসা (আ.) নামে পরিচিত।

জন্মসাল বিষয়ক বিতর্ক

যীশু খ্রিস্টের জন্মসাল ও জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস নিয়ে অবশ্য কিছু বিতর্ক আছে যা বিশেষজ্ঞরা সমাধানের চেষ্টা করে আসছেন। জনশুমারির এবং যীশুর জন্ম বিষয়ক এই তথ্যের উৎস হচ্ছে গসপেল অফ লিউক। 

এখানে তর্কের মূল ক্ষেত্রটি হচ্ছে গসপেল অফ লিউক অনুসারে জনশুমারিটি পরিচালিত হয় সিরীয় প্রাদেশিক শাসক কুইরিনিয়াসের সময়, যিনি ৬ থেকে ৭ খ্রিস্টাব্দে জুডেয়া অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যীশু খ্রিস্টের জন্ম হয় তার বেশ আগে রাজা হেরডের শাসনামলে। 

এখানে দুইটি ব্যাখা পাওয়া যায় গবেষকদের কাছ থেকে। শিক্ষক ও গবেষক জন রিস্টের মতে সমস্যাটির কারণ গসপেল অফ লিউকের একটি অংশের ভুল বানান থেকে হতে পারে। সম্ভবত এখানে কুইনটিলাসের (𝙆oʟ𝗏ᴛíλıos) বদলে কুইরিনিয়াস (𝙆𝘷pήᴠıos) লেখা হয়েছে। তার মতে গসপেল অফ লিউকের প্রথম দিকের কোন অনুলেখকের বা সূত্রের বানান ভুলের কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের লিবার্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েইন ব্রিন্ডল একাধিক বিশেষজ্ঞের কাজকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে এই সমস্যার কারণ ল্যাটিন ভাষা ও তার ইংরেজি ভাষান্তরের পার্থক্য। গসপেল অফ লিউকে বোঝানো হয়েছে কুইরিনিয়াসের সময়ের মত এক জনশুমারির সময়, যেটি ছিল প্রথম জনশুমারি, যীশুর জন্ম হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, কুইরিনিয়াসের এই জনশুমারিকে ঘিরে সেখানে বিদ্রোহ হয়েছিল তাই এই জনশুমারিটি কিছুটা বিখ্যাত ছিল। তাই ধারণা করা যায়, এই জনশুমারিকে উদ্ধৃত করে জনশুমারি কী তা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। 

এছাড়া সে সময় বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিকবার জনশুমারি পরিচালনার প্রমাণ পাওয়া যায়। গল অঞ্চলে (বর্তমান ফ্র্যান্স) আগস্টাস সিজারের সময় তিনবার জনশুমারি হয়েছিল। তাই ফিলিস্তিন ও জুডেয়া অঞ্চলে একাধিক জনশুমারি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

What do you think?

Written by Aaqib Md Shatil

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আল-আন্দালুসের গল্প

বার্বি কুইজ