in

৫ নভেম্বর, রাষ্ট্রদ্রোহ কিংবা প্রতিবাদের গল্প

আজ ৫ নভেম্বর। ১৬০৫ সালের এই দিনে ব্রিটেনের হাউজ অব লর্ডস ধ্বংস করতে নিয়ে গাই ফকস (Guy Fawkes) নামের এক ক্যাথলিক ষড়যন্ত্রকারী ধরা পড়েন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুরো পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত জানা যায় এবং বাকিরাও ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

যদিও ১৬০৬ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 5th November Observance Day পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় “ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র বানচালের” ঘটনাকে উদযাপনের। তবে ক্রমেই এই ঘটনার খলনায়ক বিশ্বব্যাপী পরিচিত হন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীকে।

৫ নভেম্বরের এই ঘটনার আদ্যোপান্ত নিয়েই এই লেখা।

“রাষ্ট্রদ্রোহী” ষড়যন্ত্র

১৫৩২ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি (Henry VIII) রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন এবং চার্চ অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। চার্চ অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠার পর রাজা হেনরি ক্যাথলিক গীর্জাগুলার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে থাকেন। এভাবে আস্তে আস্তে ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্টিজমের প্রভাব বাড়তে থাকে আর ক্যাথোলিসিজমের চর্চা বাঁধার মুখে পড়ে।

প্রায় ৭০ বছর পর, ১৬০৩ সালে রাজা প্রথম জেমস (James I) ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। তার আগে ক্ষমতায় ছিলেন রাণী প্রথম এলিজাবেথ (Elizabeth I), যার কিছু নীতির কারণে ক্যাথলিকরা বেশ কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং তাদের কার্যক্রম গোপনে চালিয়ে নিতে বাধ্য হয়। রাজা জেমসের মা ম্যারি অফ স্কটসকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল এবং তিনি ধর্মীয় দিক থেকে ছিলেন ক্যাথলিক। একারণে ক্যাথলিকরা ভেবেছিল রাজা জেমস ক্ষমতায় বসে ক্যাথলিকবিরোধী যেসব আইন আছে সেগুলো তুলে ফেলবেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যেও যখন এরকম কোন আভাস পাওয়া গেল না, তখন তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা শুরু হয়।

১৬০৫ সালে রবার্ট ক্যাটসবি (Robert Catesby) এবং তার নেতৃত্বে কিছু লোক ইংল্যান্ডের সংসদ অর্থাৎ হাউজ অব লর্ডস উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল রাজা জেমসকে হত্যা করা, কিন্তু আইন অনুযায়ী হাউজ অব লর্ডসের অধিবেশনে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের অনেক গণ্যমান্যরাও উপস্থিত থাকতে হয়। একারণে হাউজ অব লর্ডস ধ্বংস করে দেয়া তাদের কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, হাউজ অব লর্ডসের নিচে যে স্টোরেজ রুম (যাকে Undercroft বলা হয়) সেখানে গোলাবারুদ জমিয়ে রেখে এরপর আগুন দেয়া হবে। সে অনুযায়ী সুড়ঙ্গ বানিয়ে বিভিন্ন সময়ে ৩৬ ব্যারেল গোলাবারুদ সেখানে নিয়ে রাখা হয়। নভেম্বরের ৫ তারিখ হাউজ অব লর্ডসের অধিবেশন বসলে এগুলোতে আগুন দেয়া হবে। রাজা জেমসের মৃত্যু নিশ্চিত হলে, পুতুল শাসক (puppet) হিসাবে তার দশ বছর বয়সী মেয়ে এলিজাবেথকে ক্ষমতায় বসানো হতো।

কিন্তু এর মধ্যে একটা ঝামেলা দেখা দেয়। হাউজ অব লর্ডসে তো আরো অনেক মানুষ থাকার কথা। তারা সবাই বিনা অপরাধে মারা যাচ্ছে। এ অপরাধবোধ থেকে কোন একজন লোক অজ্ঞাত পরিচয়ে লর্ড মন্টিগলকে (Lord Monteagle) চিঠি লিখেন এবং বলেন সেদিন যেন পার্লামেন্টে না যান এবং নিজের পরিচিতদেরকেও যেন সেখানে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন। লর্ড মন্টিগল এটা রাজা জেমসের উপদেষ্টা রবার্ট সেসিলকে (Robert Cecile) দেখান, যিনি এটা রাজাকে জানান। চিঠির বক্তব্য তাদের বেশ সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। এরপর ৪-৫ নভেম্বর পার্লামেন্ট ভবনে তল্লাশি চালানো হয়। ৫ তারিখ আন্ডারক্রফটে গিয়ে দেখা যায় গাই ফকস (Guy Fawkes) নামের এক লোক সেখানে ৩৬ ব্যারেল গোলাবারুদ পাহাড়া দিচ্ছে।

তাকে গ্রেফতার করে এরপর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুরো পরিকল্পনা আর বাকি ষড়যন্ত্রকারীদের নাম সামনে আসে। পরবর্তীতে সবাইকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকজন গ্রেফতার করার সময় সংঘর্ষে মারা যায়। আর বাকিদেরকে বিচারের পর ১৬০৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

এই ঘটনার পর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন যখন বসে, তখন ৫ নভেম্বর দিনটাকে একটা বিশেষ দিন হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটা উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই আইন ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকে। তবে তারপরেও প্রতি বছরের ৫ নভেম্বর রাতের বেলায় লন্ডন শহরের আশেপাশে হাজারো মানুষ জমায়েত হয়। তারা বনফায়ার জ্বালায়, আকাশে আতশবাজি পুড়ানো হয়, কেউ কেউ ষড়যন্ত্রকারীদের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।

Remember, remember, the 5th of November, Gunpowder, treason and plot. I see no reason Why gunpowder treason Should ever be forgot.

১৬০৬ সালের জানুয়ারিতে যে দিনটাকে 5th November Observance Day পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সে দিনটা এখনো উৎসবের আমেজে Bonfire Night, Fireworks Night কিংবা Guy Fawkes Night হিসাবে পালন করা হতে থাকে।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গাই ফকসকে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা শুরু হয়।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেমস শার্পের (James Sharpe) ভাষায়,

(Guy Fawkes was) the last man to enter Parliament with honest intentions.

V for Vendetta এর মতো কাল্ট ক্লাসিকের মাধ্যমে আমরা Guy Fawkes-কে ওয়ার্ল্ডওয়াইড পপুলার হতে দেখি। এরপর হ্যাকার গ্রুপ অ্যাননিমাসের সাথে এই মাস্কের অ্যাসোসিয়েশন Guy Fawkes এর পপুলারিটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। বিভিন্ন প্রোটেস্টে চেহারা ঢাকার জন্য আর সিম্বলিজম হিসাবে Guy Fawkes মাস্ক ব্যবহার হতে থাকে। প্রতি বছর ৫ নভেম্বর এলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কাজকে উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় বলতে দেখা যায় “Ideas are bulletproof”.

আজ ৫ নভেম্বর। আজকে রাতেও লন্ডনে আমরা আতশবাজির ঝলকানি দেখবো। সবাই সোৎসাহে পালন করবে Guy Fawkes Night। কেউ কেউ তাকে মনে করবে এক ধর্মীয় উগ্রপন্থী হিসাবে যে কিনা রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আর কেউ কেউ তাকে মনে করবে একজন বিপ্লবী হিসাবে, যিনি কিনা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রবেশ করা শেষ ব্যক্তি।

What do you think?

Written by Rafeed Bhuiyan

I am I

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র

ক্রিকেটের যত অদ্ভূত আউট